*** রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা "প্রভাতসংগীত" আমাদেরকে নিয়ে যায় তার শৈশব ও কৈশোরের সংবেদনশীল সময়ে। এই গল্পটি লেখকের সৃষ্টিশীলতার প্রথম ধাপগুলোকে প্রতিফলিত করে, যেখানে তার মননের প্রথম বিকাশ এবং ভাবনার প্রথম স্ফুরণ ফুটে ওঠে। কড়ি ও কোমল রচনার পূর্ববর্তী সময়ে লেখা এই রচনায়, আমরা দেখতে পাই কিভাবে রবীন্দ্রনাথের মনের গভীরে গড়ে উঠেছিল জীবন ও মৃত্যুর দার্শনিক চিন্তাধারা, এবং কিভাবে তিনি সেই চিন্তাগুলিকে কাব্যিক ভাষায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। "প্রভাতসংগীত" হল সেই আধ্যাত্মিক ও সৃজনশীল যাত্রার প্রাথমিক পদক্ষেপ, যা পরবর্তীতে তার মহান সাহিত্যকর্মের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
প্রভাতসংগীত
কড়ি ও কোমল রচনার পূর্বে কাব্যের ভাষা আমার কাছে ধরা দেয়নি। কৈশোর বয়সে মনের ভাবগুলো নবীনত্বের আবেগ নিয়ে রূপ ধরতে চাচ্ছে, কিন্তু যে উপাদানে তাদেরকে শরীরের বন্ধন দিতে পারত, তারই অবস্থা তখন তরল। এইজন্যে ওগুলো হয়েছে ঢেউওয়ালা জলের উপরকার প্রতিবিম্বের মতো আকা-বাকা; ওরা মূর্ত হয়ে ওঠেনি, সুতরাং কাব্যের পদবীতে পৌঁছতে পারেনি। সেইজন্যেই আমার মত এই যে, কড়ি ও কোমলের পর থেকেই আমার কাব্যরচনা ভালো-মন্দ সবকিছু নিয়ে একটি স্পষ্ট সৃষ্টির ধারা অবলম্বন করেছে।
প্রভাতসংগীতে যে অবস্থায় আমার প্রথম বিকাশোন্মুখ মন অপরিণত ভাবনা নিয়ে অপরিশোধিত রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিল, তার কথা আজো আমার মনে আছে। তার পূর্বে সন্ধ্যাসংগীতের পর্বে আমার মনে কেবলমাত্র হৃদয়াবেগের গদগদ ভাষী আন্দোলন চলছিল। প্রভাতসংগীতের ধাতুতে আপনা-আপনি দেখা দিতে আরম্ভ করেছে এক-আধটা মননের রূপ, অর্থাৎ ফুল নয় সে, ফসলের পালা, সেও অশিক্ষিত বিনাচাষের জমিতে।
সেই সময়কার কথা মনে পড়ছে যখন কোথা থেকে কতকগুলো মত মনের অন্দরমহলে জেগে উঠে সদরের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল। এগুলোর নাম, অনন্ত জীবন, অনন্ত মরণ, প্রতিধ্বনি। অনন্ত জীবন বলতে আমার মনে এই একটা ভাব এসেছিল, বিশ্বজগতে আসা এবং যাওয়া ছুটোই থাকারই অন্তর্গত, ঢেউয়ের মতো আলোতে ওঠা এবং অন্ধকারে নামা। ক্ষণে ক্ষণে হ্যাঁ এবং ক্ষণে ক্ষণে না নিয়ে এই জগৎ নয়, বিশ্বচরাচর গোচর-অগোচরের নিরবচ্ছিন্ন মালা গাঁথা। এই ভাবনাটা ভিতরে ভিতরে মনকে খুব দোলা দিয়েছিল।
নিজের অন্তরের দিকে চেয়ে একটা ধারণা আমার মধ্যে জেগে উঠেছিল যে আমার প্রতিমুহূর্তের সমস্ত ভালো-মন্দ, আমার প্রতিদিনের সুখ-দুঃখের সমস্ত অভিজ্ঞতা চিরকালের মতো অনবরত একটা সৃষ্টিরূপ ধরছে, প্রকাশ-অপ্রকাশের নিত্য ওঠাপড়া নিয়ে যে সৃষ্টির স্বরূপ। এই কথাটা ভাবতে ভাবতেই মনে হল মৃত্যু তাহলে কী? একরকম করে তার উত্তর এসেছিল এই যে, জীবন সবকিছুকে রাখে আর মৃত্যু সবকিছুকে চালায়।
প্রতি মুহূর্তেই মরছি আমি, আর সেই মরার ভিতর দিয়েই আমি বাঁচার রাস্তায় এগোচ্ছি, যেন আমার মধ্যে সেলাইয়ের কাজ চলছে, গাঁথা পড়ছে অতীত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান। মুহূর্ত-কালীন মৃত্যুপরম্পরা দিয়ে মর্ত্যজীবন এই যেমন বেড়ে চলেছে প্রবাল দ্বীপের মতো, তেমনি মৃত্যুর পর মৃত্যু আমাকে দিয়ে লোক-লোকান্তরের অভিজ্ঞতার জাল বিস্তার করে চলবে। আমার চেতনার স্তরটিকে নিয়ে মৃত্যু এক-এক ফোঁড়ে এক-এক লোককে সম্পূর্ণভাবে গাঁথবে। মনে আছে এই চিন্তায় আমার মনকে খুব আনন্দ দিয়েছিল।
প্রতিধ্বনি কবিতা লিখেছিলাম যখন প্রথম গিয়েছিলাম দার্জিলিঙে। যে ভাবে তখন আমাকে আবিষ্ট করেছিল সেটা এই যে, বিশ্বসৃষ্টি হচ্ছে একটি ধ্বনি, আর সে প্রতিধ্বনিরূপে আমাকে মুগ্ধ করছে, ক্ষুব্ধ করছে, আমাকে জাগিয়ে রাখছে, সেই সুন্দর, সেই ভীষণ। সৃষ্টির সমস্ত গতিপ্রবাহ নিত্যই একটি কেন্দ্রস্থলে গিয়ে পড়ছে আর সেখান থেকে প্রতিধ্বনিরূপে নির্গত হচ্ছে আলো হয়ে রূপ হয়ে ধ্বনি হয়ে।
এই ভাবগুলো যদিও অস্পষ্ট তবু আমার মনের মধ্যে খুব প্রবল হয়ে আন্দোলিত হচ্ছিল। মুখে মুখে কোনো কোনো বন্ধুর সঙ্গে আলোচনাও করেছি। কিন্তু এসব ভাবনা তখন কী গন্ধে কী পদ্যে আলোচনা করবার সময় হয়নি, তখনো পাইনি ভাষাভারতীর প্রসাদ। তাই বলে রাখছি, প্রভাতসংগীতে এ সমস্ত লেখার আর কোনো মূল্য যদি থাকে, সে ষোলো আনা সাহিত্যিক মূল্য নয়।
***"প্রভাতসংগীত" আমাদেরকে একজন তরুণ কবির মানসিক বিকাশের একটি সুস্পষ্ট চিত্র প্রদান করে। তার মননের অভ্যন্তরে অনন্ত জীবন, অনন্ত মরণ, এবং প্রতিধ্বনি নিয়ে যে ভাবনারা উঁকি দিচ্ছিল, তা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করার প্রচেষ্টা এ রচনায় ফুটে উঠেছে। যদিও এসব ভাবনা তখনো সম্পূর্ণ পরিপক্ক হয়নি, তবুও তারা তার সৃষ্টিশীলতার ভিত্তি স্থাপন করেছে। এই রচনার মাধ্যমে লেখক তার নিজের অন্তরের গভীরতা ও জীবন-মৃত্যুর ধারনার মধ্যে সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টা করেছে। "প্রভাতসংগীত" এর মাধ্যমে লেখকের কাব্যিক যাত্রার প্রাথমিক ধাপগুলোর একটি চমৎকার প্রতিফলন দেখা যায়, যা ভবিষ্যতে তার সাহিত্যকর্মের ভিত্তি গড়ে তুলেছে।
Comments
Post a Comment