Skip to main content

ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী


***রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্মৃতিকথায় নিজের সাহিত্যিক জীবনের প্রথম দিকের কিছু স্মরণীয় ঘটনা তুলে ধরেছেন, যা তাঁর কিশোরবেলার সাহিত্যচর্চা ও বৈষ্ণব পদাবলীর প্রতি তাঁর আগ্রহের কাহিনী বর্ণনা করে। অক্ষয়চন্দ্র সরকারের নেতৃত্বে বৈষ্ণব পদাবলী প্রকাশের সময়, রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল খুবই অল্প। সেই সময়ে তাঁর অন্তর্নিহিত কৌতূহল ও শব্দতত্বের প্রতি প্রাকৃতিক আকর্ষণই তাঁকে বৈষ্ণব পদাবলীর প্রতি আগ্রহী করে তোলে। পরিবারের মধ্যে একমাত্র পাঠক হওয়ার সুবাদে তিনি পদাবলীর ব্রজবুলি ভাষার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন এবং শব্দের অর্থ অনুসন্ধান করতে থাকেন। পরবর্তীতে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ তাঁর লেখা ব্যবহার করেন, যা রবীন্দ্রনাথের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। এই স্মৃতিচারণা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক যাত্রার প্রাথমিক দিকের চ্যালেঞ্জ এবং সাফল্যের প্রতিফলন। 


                  ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী

অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয় পর্যায়ক্রমে বৈষ্ণব পদাবলী প্রকাশের কাজে যখন নিযুক্ত হয়েছিলেন, আমার বয়স তখন যথেষ্ট অল্প। সময়নির্ণয় সন্বন্ধে আমার স্বাভাবিক অন্যমনস্কতা তখনো ছিল, এখনো আছে। সেই কারণে চিঠিতে আমার তারিখকে ধারা ঐতিহাসিক বলে ধরে নেন তারা প্রায়ই ঠকেন। বর্তমান আলোচ্য বিষয়ের কাল অনুমান করা অনেকটা সহজ। বোস্কাইয়ে মেজদাদার কাছে যখন গিয়েছিলুম তখন আমার বয়স ষোলোর কাছাকাছি, বিলাতে যখন গিয়েছি তখন আমার বয়স সতেরো। নৃতন-প্রকাশিত পদাবলী নিয়ে নাড়াচাড়া করছি সে আরো কিছুকাল পূর্বের কথা। ধরে নেওয়া যাক তখন আমি চোদ্দোয় পা দিয়েছি।

খণ্ড খণ্ড পদাবলীগুলি প্রকাশ্যে ভোগ করবার যোগ্যতা আমার তখন ছিল না। অথচ আমাদের বাড়িতে আমিই একমাত্র তার পাঠক ছিলুম। দাদাদের ডেস্ক থেকে যখন সেগুলি অস্তর্ধান করত তখন তারা তা লক্ষ্য করতেন না। পদাবলীর যে ভাষাকে ব্রজবুলি বলা হত আমার কৌতূহল প্রধানত ছিল তাকে নিয়ে। শব্দতত্বে আমার কষ্টক্য স্বাভাবিক। টীকায় যে শব্দার্থ দেওয়া হত তা আমি নিঃসন্দেহে ধরে নিই নি। এক শব্দ যতবার পেয়েছি তার সমুচ্চয়ন তৈরি করে যাচ্ছিলুম। একটি ভালো বাঁধানো খাতা শব্দে ভরে উঠেছিল। তুলনা করে আমি অর্থ নির্ণয় করেছি।


তার পরের সোপানে ওঠা গেল পদাবলীর জালিয়াতিতে। অক্ষয়বাবুর কাছে শুনেছিলুম বালক কবি চ্যাটুজ্যের গল্প। তাকে নকল করবার লোভ হয়েছিল। এ কথা মনেই ছিল না যে ঠিকমত নকল করতে হলেও শুধু ভাষায় নয় ভাবে খাঁটি হওয়া চাই। নইলে কথার গাথুনিটা ঠিক হলেও সুরে তার ফাঁকি ধরা পড়ে। পদাবলী শুধু কেবল সাহিত্য নয় তার রসের বিশিষ্টতা বিশেষ ভাবের সীমানার দ্বারা বেষ্টিত। সেই সীমানার মধ্যে আমার মন স্বাভাবিক স্বাধীনতার সঙ্গে বিচরণ করতে পারে না। তাই ভানুসিংহের সঙ্গে বৈষ্ণব-চিত্তের অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা নেই। এইজন্যে ভানুসিংহের পদাবলী বহুকাল সংকোচের সঙ্গে বহন করে এসেছি। একে সাহিত্যে একটা অনধিকার প্রবেশের দৃষ্টান্ত বলেই গণ্য করি।
প্রথম গানটি লিখেছিলুম একটা স্কেলের উপরে, অন্তঃপুরের কোণের ঘরে--
গহনকুঞ্জমাঝে
মৃদুল মধুর বংশী বাজে।
মনে বিশ্বাস হল চ্যাটুজ্যের চেয়ে পিছিয়ে থাকব না।

এ কথা বলে রাখি ভানুসিংহের পদাবলী ছোটো বয়স থেকে অপেক্ষাকৃত বড়ো বয়স পর্যন্ত দীর্ঘকালের সূত্রে গাঁথা। তাদের মধ্যে ভালোমন্দ সমান দরের নয়।

পরবর্তীকালে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ যখন বিদ্বাপতির সটীক সংস্করণ প্রকাশ করতে প্রবৃত্ত হলেন তখন আমার খাতা তিনি সম্পূর্ণ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। তার কাজ শেষ হয়ে গেলে সেই খাতা তার ও তার উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে ফিরে পাবার অনেক চেষ্টা করেও কৃতকার্য হতে পারি নি। যদি ফিরে পেতুম তা হলে দেখাতে পারতুম কোথাও কোথাও যেখানে তিনি নিজের ইচ্ছামত মানে করেছেন ভুল করেছেন। এটা আমার নিজের মত।

 

***রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই স্মৃতিচারণায় তাঁর সাহিত্যিক জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ের অসাধারণ কাহিনী উঠে এসেছে। বৈষ্ণব পদাবলীর প্রতি তাঁর আগ্রহ এবং সেই সময়ে তাঁর সংগ্রহ করা শব্দার্থের খাতা তাঁর ভাষা ও সাহিত্য জ্ঞানের প্রতি গভীর নিষ্ঠার পরিচয় দেয়। যদিও পদাবলী নকল করার চেষ্টায় তিনি স্বীকার করেন যে, সাহিত্যিক ভাবে খাঁটি হওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তবুও এই অভিজ্ঞতা তাঁকে ভবিষ্যতে আরও সতর্ক ও সৃষ্টিশীল হতে শিখিয়েছে। তাঁর লেখা ভানুসিংহের পদাবলী যদিও নিজের মতে অনধিকার প্রবেশ বলে গণ্য হয়, তবুও এই চর্চা তাঁকে সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করেছে। এই স্মৃতিচারণা আমাদেরকে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সূচনালগ্নের কিছু অজানা অধ্যায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং তাঁর সৃষ্টিশীল মননের অগ্রযাত্রার প্রেরণা হয়ে থাকে। 


Comments

Popular posts from this blog

A Short Story "A Cosmopolite in a Café" by O. Henry.

  In the bustling ambiance of a café , amidst the clinking of glasses and the hum of conversation, unfolds a tale of worldly wisdom and cultural exchange. O. Henry's "A Cosmopolite in a Café" delves into the life of a true citizen of the world, whose experiences and perspectives transcend geographical boundaries. Set against the backdrop of a vibrant café scene, this story explores the universal themes of human connection and the richness of diversity. Join us as we journey through the insightful musings of a cosmopolite, navigating through the complexities of life with wit and charm.                A Cosmopolite in a Café A T MIDNIGHT THE CAFÉ was crowded. By some chance, the little table at which I sat had escaped the eye of incomers, and two vacant chairs at it extended their arms with venal hospitality to the influx of patrons. And then a cosmopolite sat in one of them, and I was glad, for I held the theory that since Adam, no true citi...

LADY CAROLINE'S TACTICS

              LADY CAROLINE'S TACTICS. Helmsley Court was generally considered one of the prettiest houses about Beaminster; a place which was rich in pretty houses, being a Cathedral town situated in one of the most beautiful southern counties of England. The village of Helmsley was a picturesque little group of black and white cottages, with gardens full of old-fashioned flowers before them and meadows and woods behind. Helmsley Court was on slightly higher ground than the village, and its windows commanded an extensive view of lovely country bounded in the distance by a long low range of blue hills, beyond which, in clear days, it was said, keen eyes could catch a glimpse of the shining sea. The house itself was a very fine old building, with a long terrace stretching before its lower windows, and flower gardens which were the admiration of half the county. It had a picture gallery and a magnificent hall with polishe...

JANETTA AT HOME

                       JANETTA AT HOME. When Lady Caroline drove away from Gwynne Street, Janetta was left by the tumbledown iron gate with her father, in whose hand she had laid both her own. He looked at her interrogatively, smiled a little and said—"Well, my dear?" with a softening of his whole face which made him positively beautiful in Janetta's eyes. "Dear, dearest father!" said the girl, with an irrepressible little sob. "I am so glad to see you again!" "Come in, my dear," said Mr. Colwyn, who was not an emotional man, although a sympathetic one. "We have been expecting you all day. We did not think that they would keep you so long at the Court." "I'll tell you all about it when I get in," said Janetta, trying to speak cheerily, with an instinctive remembrance of the demands usually made upon her fortitude in her own home. "Is mamma in?" She always spoke of the present Mrs. Colwyn, as ...